ইসলামের আলোকে যাকাত
اَلْـحَـمْـدُ لِـلّٰـهِ رَبِّ الْـعٰـلَـمِـيْـنَ وَالـصَّـلٰوةُ وَالـسَّـلَامُ عَـلٰـي رَسُـوْلِـهِ الْـكَـرِيْـمِ وَعَـلٰـي اٰلِـهِ وَاَصْـحَـابِـهِ اَجْـمَـعِـيْـنَ- اَمَّـا بَـعْـدُ-
ভূমিকা
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত একটি অন্যতম স্তম্ভ¢। ঈমান, সালাত ও সাওমের পর এর স্থান। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমান নর-নারীর উপর এটা ফরজ করা হয়েছে। যাকাত পূর্ববর্তী নবী ও তাদের উ¤মতদের উপরও ফরজ ছিল। কেহ তা অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে সালাতের সাথে সাথে যাকাতের কথা ৩৬ টি আয়াতে বলেছেন। তাই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় দারিদ্র বিমোচনে যাকাতের গুরুত্ব¡ অপরিসীম।
যাকাতের সংজ্ঞা
যাকাত আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ প্রবৃদ্ধি, পবিত্রতা ও বিশুদ্ধ ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় যাকাতের অর্থ হলো, “সম্পদশালী মুসলমানদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ (বছরের হিসাবান্তে উদ্ধৃত্ত সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ ২.৫%) আল্লাহ তা‘আলা ঘোষিত শরীয়াত নির্ধারিত খাতে কোন লাভ-লোকসান ও সুনাম কিংবা কোন বৈষয়িক স্বার্থ (উপকার) ব্যতীত সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে দান করা।”
যাকাত পূর্ববর্তী শরীয়তেও ফরয ছিল (আঃ)
যাকাত শুধু উম্মতে মোহাম্মদীর জন্যই ফরয নয়, ইহা পূর্ববর্তী সকল শরীয়তেই ফরয ছিল। যেমন মূসা (আঃ)-এর শরীয়তে যাকাত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ﴿البقرة: ٨٣﴾
“যখন আমি বনী-ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও উপাসনা করবে না, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও দীন দরিদ্রের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষকে সৎ কথাবার্তা বলবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দেবে।”-সূরা বাকারা ঃ ৮৩
লুত (আঃ), ইসহাক (আঃ), ইয়াকুব (আঃ)-এর উ¤মতের উপর যাকাত
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَإِقَامَ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءَ الزَّكَاةِ ۖ وَكَانُوا لَنَا عَابِدِينَ ﴿الأنبياء: ٧٣﴾
“আমি তাদেরকে নেতা করলাম। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করতেন। আর আমি তাদের প্রতি প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি ভাল কাজ করতে, সালাত আদায় করতে, যাকাত আদায় করতে। আর তারা আমারই ইবাদতকারী।’’ -সূরা আম্বিয়া ঃ ৭৩
ইসমাঈল (আঃ)-এর সম্পর্কে বলা হয়েছে,
وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ وَكَانَ عِندَ رَبِّهِ مَرْضِيًّا ﴿مريم: ٥٥﴾
“আর তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে আদেশ করতেন সালাতের ও নির্দেশ দিতেন যাকাত আদায়ের। আর তিনি তার প্রভুর কাছে পছন্দনীয় ছিলেন।’’ -সূরা মারইয়াম ঃ ৫৫
ঈসা (আঃ)-এর বাণী। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা,
وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا ﴿مريم: ٣١﴾
“আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে কল্যাণময় (বরকতময়) করেছেন। আর তিনি আমাকে উপদেশ দিয়েছেন, যতদিন আমি জীবিত থাকি ততদিন সালাত এবং যাকাত আদায় করতে।’’ -সূরা মারইয়াম ঃ ৩১
উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য যাকাতের ফরযিয়্যত ও শর’য়ী হুকুম
যাকাত ইসলামের বুনিয়াদী আমলের মধ্যে ফরয তথা অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয় যা উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপর ফরয হয় ২য় হি ঃ রমাদান মাসে। আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়ে বলেন,
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ ﴿البقرة: ٤٣﴾
“তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকুকারীদের সাথে একত্রিত হয়ে রুকু কর (জামাতের সাথে সালাত আদায় কর)।’’ -সূরা বাকারা ঃ ৪৩
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنفُسِكُم مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِندَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ﴿البقرة: ١١٠﴾
“আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং যে সকল নেক কাজ তোমরা নিজেদের কল্যাণে এখানে (দুনিয়ার জীবনে) করবে, তার সবটুকুর প্রতিফল আল্লাহর কাছে (পরকালে) পাবে।’’ -সূরা বাকারা ঃ ১১০
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় দারিদ্র বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা
ইসলামী সমাজের অর্থ ব্যবস্থায় ব্যক্তির সম্পদ লাভ করার যেমন অধিকার আছে, তেমনি তা শুধু নিজে ভোগ করার সুযোগ নেই। সকল সম্পদশালীর সম্পদে নিঃস্ব, দুস্থ ও দরিদ্রদেরও হক বা অধিকার দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَّعْلُومٌ *لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ ﴿المعارج: ٢٤ -٢٥﴾
“এবং তাদের ধন-সম্পদে নির্ধারিত হক আছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতের।’’-সূরা মা’য়ারিজ ঃ ২৪-২৫
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ ﴿الذاريات: ١٩﴾
“এবং তাদের ধন-সম্পদে, প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক ছিল।’’ -সূরা যারিয়াত ঃ ১৯
نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُم مَّعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۚ وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِّيَتَّخِذَ بَعْضُهُم بَعْضًا سُخْرِيًّا ۗ وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ ﴿الزخرف: ٣٢﴾
“(তারা কি আপনার পালনকর্তার রহমত বন্টন করে ?) আমি তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বন্টন করেছি পার্থিব জীবনে এবং একের মর্যাদাকে অপরের ওপর উন্নীত করেছি, যাতে একে অপরকে সেবক রূপে গ্রহণ করে। তারা যা সঞ্চয় করে, আপনার পালনকর্তার রহমত তদপেক্ষা উত্তম।’’-সূরা যুখরুফ ঃ ৩২
এ উদ্দেশ্যে কুরআন মাজীদের অন্যতম গুরুত্ব¡পূর্ণ বুনিয়াদী নির্দেশ হলো ঃ
كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ ﴿الحشر: ۷﴾
“ধন যাতে শুধুমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যেই পুঞ্জিভূত (আবর্তিত) হয়ে না থাকে।’’ -সূরা হাশর ঃ ৭
যাকাত না দেয়ার পরিণাম
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ ﴿التوبة: ٣٥-٣٤﴾
“যারা স্বর্ণ ও রুপা জমা করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদের যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন দোযখের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপাল (ললাট), পার্শ¦ ও পৃষ্ঠদেশে ছাপ (ছ্যাক) দেয়া হবে, (সেদিন বলা হবে) এটি তোমাদের সে সম্পদ, যা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং তোমরা যা জমা করেছ, তার স্বাদ গ্রহণ কর।’’ -সূরা তাওবা ঃ ৩৫-৩৬
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُم بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ﴿آلعمران: ١٨٠﴾
“আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পন্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পন্য করে সে সমস্ত ধন-স¤পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচেছন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে স¤পর্কে জানেন।’’ -সূরা আলে ইমরান ঃ ১৮০
الَّذِينَ لَا يُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُم بِالْآخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ ﴿فصلت: ٦﴾
“যারা যাকাত দেয় না তারাই হলো পরকালে অবিশ্বাসী কাফের।’’-সূরা হা-মীম আস্সাজদা ঃ ৭
الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِالْفَحْشَاءِ ۖ وَاللَّهُ يَعِدُكُم مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَفَضْلًا ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿البقرة: ٢٦٨﴾
“শয়তান তোমাদেরকে অভাব-অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ¬ীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও বেশি অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সুবিজ্ঞ।’’ -সূরা বাক্বারা ঃ ২৬৮
الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَيَكْتُمُونَ مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ۗ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا ﴿النساء: ٣٧﴾
“যারা নিজেরা কার্পণ্য করে এবং অন্যকেও কৃপণতা শিক্ষা দেয় আর গোপন করে সেসব বিষয় যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন স্বীয় অনুগ্রহে বস্তুত তৈরি করে রেখেছি কাফেরদের জন্য অপমানজনক আযাব।’’ -সূরা নিসা ঃ ৩৭
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَأْخُذ بِلِهْزِمَتَيْهِ - يَعْنِي بشدقيه - يَقُولُ: أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ ". ثُمَّ تَلَا هَذِه الْآيَة: (وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ من فَضله) إِلَى آخر الْآيَة (رَوَاهُ البُخَارِيّ)
“আল্লাহ যাকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তারপর সে এর যাকাত আদায় করল না, কিয়ামতের দিন তার এ মালকে এমন বিষধর সাপের আকৃতিতে রূপান্তরিত করা হবে। তারপর এ সাপকে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে এবং সে ঐ মালদারের চোয়ালে দংশন করবে এবং বলতে থাকবে, “আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত ধন”। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) (কুরআন মজীদের এ আয়াতটি) তিলাওয়াত করলেন: (যার অর্থ এরূপ) “যারা কৃপণতা করে সে সব সম্পদ ব্যয়ে, যা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অনুগ্রহ করেছেন---(আয়াতের শেষ পর্যন্ত)।’’ -বুখারী; মুসলিম; ইবন মাজাহ; মিশকাত ঃ ১৭৭৪
যাকাত আদায়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর পদক্ষেপ
হাদীস শরীফে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ فَقَالَ: ্রإِنَّك تَأتي قوما من أهل الْكتاب. فَادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ. فَإِنْ هُمْ أطاعوا لذَلِك. فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي الْيَوْمِ وَاللَّيْلَةِ. فَإِنْ هم أطاعوا لذَلِك فأعلمهم أَن الله قد فرض عَلَيْهِم صَدَقَة تُؤْخَذ من أغنيائهم فَترد فِي فُقَرَائِهِمْ. فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ. فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَين الله حجابগ্ধ (مُتَّفق عَلَيْهِ)
“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুয়াজকে (রাঃ) ইয়ামেনের গভর্ণর হিসেবে পাঠিয়ে বললেন: তুমি কিতাবধারীদের এক সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ, কাজেই প্রথমে তাদেরকে আহবান করবে এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করতে যে, “আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, আর মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল”। যদি তারা এটা মান্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দিবে যে আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর প্রতি দিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করে দিয়েছেন। যদি একথাও তারা মেনে নেয় তবে তাদেরকে জানিয়ে দিবে য়ে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য যাকাত ফরজ করেছেন, যা ধনীদের নিকট থেকে আদায় করতঃ দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হবে। যদি একথাও তারা মেনে নেয় তবে তোমার উচিত হবে তাদের উত্তম সম্পদ পরিহার করা। তুমি মজলুমের বদ দু’আ থেকে নিজেকে বাঁচাও। কেননা, আল্লাহ ও মজলুম ব্যক্তির মাঝে কোন পর্দা থাকে না।’’ -বুখারী; মুসলিম; মিশকাত ঃ ১৭৭২
যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে আবূ বকর (রাঃ)-এর পদক্ষেপ
(রিদ্দার যুদ্ধ )
হাদীস শরীফে এসেছে,
عن ابي هريرة (رض) قال لَمَّا تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَاسْتُخْلِفَ أَبُو بَكْرٍ بَعْدَهُ وكَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنَ الْعَرَبِ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ لأَبِي بَكْرٍ كَيْفَ تُقَاتِلُ النَّاسَ وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَمَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ عَصَمَ مِنِّي مَالَهُ وَنَفْسَهُ إِلاَّ بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ " . قَالَ أَبُو بَكْرٍ وَاللَّهِ لأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الزَّكَاةِ وَالصَّلاَةِ فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ الْمَالِ وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُونِي عِقَالاً كَانُوا يُؤَدُّونَهُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهِ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ وَاللَّهِ مَا هُوَ إِلاَّ أَنْ رَأَيْتُ أَنَّ اللَّهَ قَدْ شَرَحَ صَدْرَ أَبِي بَكْرٍ لِلْقِتَالِ فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الْحَقُّ-(بخاري, مسلم, ابوداؤد, نسائ, ترمذى)
“আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওফাত হল এবং আবূ বকর (রাঃ) এরপর খলীফা নির্বাচিত হলেন, আর আরবের যারা (যাকাত প্রদানে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে) কাফির (মুরতাদ) হয়ে যাওয়ার তারা কাফির হয়ে গেল (তখন আবূ বকর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন)। উমর (রাঃ) তাঁকে বললেন, কিভাবে আপনি লোকদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করবেন, অথচ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “লোকেরা লা ইলাহা ইললালাহ-এর সাক্ষ্য না দেয়া পর্যন্ত আমাকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইললালাহ¬ বলবে, তার জান ও মাল আমার থেকে নিরাপদ হয়ে গেল, তবে তাঁর নিজের হক ব্যতীত, তাঁর হকের হিসাব তাঁরই উপর” (সুতরাং এ কথা জানার পর কিভাবে আপনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন?)। আবূ বকর (রাঃ) বললেন: আল্লাহর কসম! যারা সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব! কেননা, যাকাত হল সম্পদের হক। আল্লাহর কসম! যারা উটের রশির যাকাত দিতেও অস্বীকার করবে, যার যাকাত রাসূলের নিকট দেয়া হত, আমি তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করব। আবূ বকরের এমন প্রতিজ্ঞা শুনে উমর বললেন, আল্লাহর কসম! আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা যুদ্ধের জন্য আবূ বকরের বক্ষকে উম্মুক্ত করে দিয়েছেন, আমি বুঝতে পারলাম যে, তার সিদ্ধান্ত সত্য।’’ -বুখারী, মুসলিম, আবূ দাঊদ, নাসাঈ; তিরমিযী; মিশকাত ঃ ১৭৯০
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত
১। মুসলমান হওয়া।
২। নিসাব বা শরীয়াত নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া।
৩। সম্পদ প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া।
৪। ঋণগ্রস্থ না হওয়া।
৫। সম্পদ এক বছর স্থায়ী হওয়া।
৬। জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া (পাগল বা বেহুস না হওয়া)।
৭। বালেগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) হওয়া।
৮। স্বাধীন হওয়া।
যাকাত ফরয হওয়ার সময়-সীমা
আব্দুল্লাহ্ ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রمَنِ اسْتَفَادَ مَالًا فَلَا زَكَاة فِيهِ حَتَّى يحول عيه الْحَوْلُগ্ধ ( رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ)
“যে লোক কোন ধন-সম্পদ লাভ করলো, তা তার নিকট পূর্ণ একটি বছর অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে তার ওপর যাকাত ফরয হবে না।’’ -তিরমিযী; মিশকাত ঃ ১৭৮৭
নিসাবের পরিমাণ/ কি পরিমাণ সম্পদের যাকাত ফরজ
যদি কারো নিকট তার প্রয়োজনীয় সব খরচ বাদ দিয়ে সাড়ে বায়ান্ন (৫২ ১২ ) তোলা (ভরি) বা ৬১৩ গ্রাম রৌপ্য অথবা সাড়ে সাত (৭১২ ) তোলা (ভরি) বা ৮৮ গ্রাম স্বর্ণ অথবা সমপরিমান মূল্যের মাল বা নগদ অর্থ এক বছর যাবৎ জমা থাকে, তার উপর যাকাত ফরজ। এটাকে শরীয়াতের পরিভাষায় নিসাব বলা হয়।
যেসকল বস্তুর যাকাত দিতে হয়
১। স্বর্ণ-রৌপ্য ও ইহার অলংকার।
২। নগদ অর্থ-সম্পদ বা টাকা-পয়সা।
৩। ব্যবসার মাল বা জিনিস।
৪। গবাদী পশু।
৫। উৎপাদিত ফসলের যাকাত।
৬। খনিজ সম্পদ। যেমন স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ, রং, আরসেনিক, তৈল, লবন ইত্যাদি।
৭। ডিপিএস, এসডিপিএস, হজ্জ বীমা, মোহরানা বীমা, পেনশন বীমাসহ বিভিন্ন প্রকারের বীমা প্রকল্পের।
৮। আধুনিক পদ্ধতিতে বিনিয়োগ বা মওজুদ অর্থ যেমন শেয়ার সার্টিফিকেট, প্রাইজবন্ড, কোন কিছুর সিকিউরিটি বা যামানত, ডিপোজিট, ফিক্স ডিপোজিট, চলতি হিসাব, সঞ্চয়ী হিসাব ইত্যাদির যাকাত দিতে হবে।
কোন বস্তুর কি পরিমান যাকাত দিতে হবে
১। স্বর্ণ, রৌপ্য ও নগদ টাকার শতকরা ২.৫ ভাগ।
২। ব্যবসার মাল বা জিনিসের শতকরা ৪০ ভাগের ১ ভাগ। অথবা স্বর্ণ, রৌপ্য ও টাকার হিসাব করে শতকরা ২.৫ ভাগ।
৩। গবাদী পশু
ক। উট সর্বনি¤œ ৫টি হলে ১টি ছাগল যাকাত দিতে হবে।
খ। গরু-মহিষের সর্বনি¤œ ৩০টি হলে যাকাত দিতে হবে।
গ। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা সর্বনি¤œ ৪০টি হলে ১টি ছাগল অথবা ভেড়া অথবা দুম্বা যাকাত দিতে হবে।
৪। ফসলের যাকাত
ক। বৃষ্টির পানিতে উৎপন্ন ফসলের ১০ ভাগের ১ ভাগ।
খ। সেচের পানিতে উৎপন্ন ফসলের ২০ ভাগের ১ ভাগ।
যে সকল বস্তুর যাকাত দিতে হবে না ঃ
১। বসবাসের বাড়ি।
২। ব্যবহারের গাড়ী।
৩। ব্যবহারের আসবাবপত্র।
৪। কলকারখানার যন্ত্রপাতি।
৫। ডেইরী ফার্মের পশু।
৬। যে সকল জিনিস ভাড়ায় খাটানো হয়। যেমন বাস, রিক্সা, ট্যাক্সি, ট্রাক, মাইক্রো, ডেকোরেশনের মালামাল ইত্যাদি তবে বাৎসরিক আয়ের উপর যাকাত দিতে হবে।
৭। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র ও অফিসের জিনিসপত্র।
৮। সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান।
৯। সরকারী মালিকানাভূক্ত নগদ অর্থ ও সোনা-রূপার যাকাত দিতে হবে না।
১০। শাক-সব্জি ও তরিতরকারীর কোন যাকাত দিতে হবে না।
যাদেরকে যাকাত দিতে হবে বা যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহ
আল্লাহ তা‘আলা শুধু যাকাত আদায় করা ফরয এবং তার গুরুত্ব¡ ও ফযীলত বর্ণনা করেই শেষ করেন নি, বরঞ্চ এ যাকাত কোথায় কোথায় ব্যয় করা হবে তার খাতসমূহও উল্লেখ করে দিয়েছেন। আল্লাহ পাকের বাণী,
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ﴿التوبة: ٦٠﴾
“নিশ্চয়ই এ সদকা (যাকাত) হলো কেবল ফকীরদের এবং মিসকীনদের জন্যে, আর তাদের জন্যে যারা এ কাজের (যাকাত আদায় ও বন্টনের) জন্য নিয়োজিত কর্মচারী এবং তাদের জন্য যাদের ইসলামের পক্ষে মন জয় করা প্রয়োজন (নওমুসলিম)। আর তাদের (মুক্তির) জন্যে যারা দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দি, ঋণগ্রস্থদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্যে। এটা হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ফরজ বা নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’’ -সূরা তাওবা ঃ ৬০
যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না
১। পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী ও তাদের পিতা-মাতা।
২। সন্তান-সন্ততি, নীচের দিক পর্যন্ত, যথা ঃ ছেলে-মেয়ে, পৌত্র-প্রপৌত্রী, নাতী-নাতনী প্রভৃতি।
৩। সাহেবে নেসাব ধনী বা সচ্ছল ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ দেয়া নাযায়েজ।
৪। অমুসলিমকে (কাফির-মুশরিককে) যাকাত দেয়া যাবে না।
৫। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে যাকাত দেয়া যাবে না।
৬। বনী হাশেম বংশধরদের তিন গোত্রকে যাকাত দেয়া যায়েজ নাই। যেমন
ক। আব্বাস (রাঃ) এর বংশধর। খ। হারেস (রাঃ) এর বংশধর। গ। আবূ তালেব (রাঃ) এর বংশধর।
৭। এছাড়াও মুহাম্মদ (সাঃ) -এর পরিবার ও বংশধরকে যাকাত দেয়া হালাল নয়।
উল্লেখ্য, যাদের ব্যয়ভার ও ভরণ-পোষণ বহন করা সরাসরি ও স্বাভাবিকভাবেই যাকাতদাতার ওপর, তাদের ব্যতীত অন্যান্য ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাগিনা, চাচা-চাচী, ফুফা-ফুফি ও খালা-খালু প্রভৃতি নিকটাত্মীয়কে যাকাত দেয়া শুধু জায়েয নয় বরং উত্তমও বটে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
عَنْ سَلْمَانَ بْنِ عَامِرٍ الضَّبِّيِّ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَعَلَى ذِي الْقَرَابَةِ اثْنَتَانِ: صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ " (ابن ماجه)
“(সাধারণ) গরীব-মিসকীনদের দান (যাকাত) করা হলে তা হবে শুধু দান (যাকাত) করার সাওয়াব। আর নিকটাত্মীয়দেরকে দান (যাকাত) করা হলে একদিকে দান, অপরদিকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার উভয় সাওয়াব।’’ -ইবন মাজাহ ঃ ১৮৪৪
যাকাত প্রদানের ফায়দা বা ফযীলত
যাকাত সম্পদ বৃদ্ধি করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ ﴿الروم: ٣٩﴾
“আর তোমরা মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য যে বৃদ্ধি (সুদ) প্রদান কর তা আল্লাহর নিকট বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তোমরা যে যাকাত প্রদান কর, মূলত সেই যাকাত দানকারীরাই প্রকৃতপক্ষে তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে।’’ -সূরা রুম ঃ ৩৯
যাকাত সম্পদকে পবিত্র করে
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ ۖ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ﴿التوبة: ١٠٣﴾
“তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। আর তুমি তাদের জন্য দু‘আ কর, নিঃসন্দেহে তোমার দু‘আ তাদের জন্য সান্তনাস্বরূপ। বস্তুত আল্লাহ সবকিছুই শোনেন, জানেন।’’ -সূরা তাওবাহ্ ঃ ১০৩
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ لَمْ يَفْرِضِ الزَّكَاةَ إِلاَّ لِيُطَيِّبَ مَا بَقِيَ مِنْ أَمْوَالِكُمْ (رَوَاهُ أَبُو دَاوُد)
“আল্লাহ পাক তো যাকাত এজন্যই ফরয করেছেন, যাতে তোমাদের অবশিষ্ট মাল পাক-পবিত্র হয়ে যায়।’’ -আবূ দাঊদ; মিশকাত ঃ ১৭৮১
সম্পদের যাবতীয় অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয় ঃ
হাদীসে এসেছে,
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَرَأَيْتَ إِذَا أَدَّى رَجُلٌ زَكَاةَ مَالِهِ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রمَنْ أَدَّى زَكَاةَ مَالِهِ، فَقَدْ ذَهَبَ عَنْهُ شَرُّهُগ্ধ(المعجم الاوسط)
“জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “এক ব্যক্তি বলল; হে আল্লাহর রাসূল! কোন ব্যক্তি যদি তার মালের যাকাত আদায় করে তাহলে তার ফায়দা বা উপকারীতা কী? তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত প্রদান করে, তার সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয়ে যায়।’’ -আলমু‘জামুল আওসাত ঃ ১৫৭৯
আখিরাতে রয়েছে আল্লাহ তা’আলার মহা পুরস্কার
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ* إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿البقرة: ٢٧٧-٢٧٦﴾
“আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে। নিশ্চয় যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, সালাত প্রতিষ্ঠা করেছে এবং যাকাত প্রদান করেছে, তাদের জন্যে তাদের পুরস্কার তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে। তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং তাঁরা দুঃখিত হবে না।’’ -সূরা বাক্বারা ঃ ২৭৬-২৭৭
যাকাত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রمَنْ فَارَقَ الدُّنْيَا عَلَى الْإِخْلَاصِ لِلَّهِ وَحْدَهُ، وَعِبَادَتِهِ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَإِقَامِ الصَّلَاةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، مَاتَ وَاللَّهُ عَنْهُ رَاضٍগ্ধ
“আল্লাহর প্রতি পরম আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা, তাঁর শিরকমুক্ত ইবাদত, সালাত কায়েম ও যাকাত দেয়া অবস্থায় যেলোক দুনিয়া ত্যাগ করল, সে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত হিসেবেই দুনিয়া ছেড়ে গেল।’’ -ইবন মাজাহ ঃ ৭০
জাতীয় অর্থ ব্যবস্থায় যাকাতের গুরুত্ব¡
ক। সামাজিক গুরুত্ব¡
১। দারিদ্র লাঘব।
২। ভাতৃত্ব বোধের উ¤েমষ।
৩। সহানুভূতি সৃষ্টি।
৪। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর।
৫। সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধি।
খ। ধর্মীয় গুরুত্ব¡
১। সম্পদের বৃদ্ধি, পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা।
২। আল্লাহর নির্দেশ পালন।
৩। ঈমানের পরিচয়।
৪। আত্মিক শান্তি।
৫। পরকালীন মুক্তি।
গ। নৈতিক গুরুত্ব¡
১। রাষ্ট্র্রীয় আয়।
২। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা।
৩। অর্থনৈতিক অনটন বিমোচন।
৪। কর্মসংস্থান।
৫। ঋণমুক্তি।
৬। জনহিতকর কার্য।
‘যাকাত’ ও ‘ট্যাক্স বা কর’-এর মধ্যে প্রার্থক্য
যাকাত আদায় করতে গিয়ে আমাদের মাঝে বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দেয়। যেমন যারা রাষ্ট্র্রীয়ভাবে কর বা ট্যাক্স দিয়ে থাকে, তাদের যাকাত দিতে হবে কেন? অথবা আদায়কৃত কর বা ট্যাক্সের অংশ যাকাতের অংশ হিসেবে আদায় হবে না কেন? ইত্যাদি। এ বিষয়ে আমাদের ভালোভাবে জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, যাকাত ও কর বা ট্যাক্স কখনো এক জিনিস নয়। বরং মৌলিক ধারণা ও নৈতিক মর্যাদার দিক থেকে উভয়ের মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য রয়েছে। যেমন
১। প্রকৃতপক্ষে যাকাত একটা অর্থনৈতিক ইবাদত। আর কর বা ট্যাক্স হলো রাষ্ট্র্রীয় আইন।
২। যাকাতের টাকা সরকার গ্রহণের ব্যবস্থা করলেও তা আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত আট শ্রেণীর বাহিরে খরচ করা যায় না, কিন্তু কর বা ট্যাক্সের টাকা ইচ্ছা মত ব্যয় করা যায়। যা দ্বারা রাষ্ট্র্রের সকল নাগরিকই সুবিধা ভোগ করতে পারে।
৩। যাকাতের পরিমাণ নির্ধারিত; কেউ এতে কম বেশ করতে পারবে না। আজ থেকে প্রায় পনের শ’ বছর পূর্বে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কর্তৃক যে হার নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তা অপরিবর্তনীয়। কিন্তু কর বা ট্যাক্সের পরিমাণ সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী যে কেউ কম বা বেশী করার অধিকার রাখেন।
৪। যাকাত মূলত শুধু মুসলমানদের ওপর ফরয যা তাদের ঈমান ও আমলের সাথে সম্পৃক্ত। পক্ষান্তরে কর বা ট্যাক্স হলো মুসলিম-অমুসলিম রাষ্ট্রের সকল নাগরিক তা পরিশোধ করতে বাধ্য। যদি সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে তা গ্রহণের ব্যবস্থা করেন।
যাকাতের কিছু মাসয়ালা (বিধান) ঃ
১। কোন ব্যক্তির নিকট কিছু সোনা, কিছু রুপা, কিছু নগদ টাকা ও কিছু ব্যবসার মাল থাকলে, সব মিলিয়ে যদি সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা যার বর্তমান (২০১৪ ইং) বাজার মূল্য ৬৫ হাজার টাকার সমান হয়, তাহলে যাকাত দিতে হবে।
২। যৌথ মালিকানাধীন মিল-ফ্যাক্টরীর প্রত্যেক শেয়ারের মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তবে প্রত্যেককে আলাদাভাবে যাকাত দিতে হবে।
৩। কেউ কাউকে নিসাব পরিমাণ ঋন দিলে বছর শেষে ঋণদাতাই যাকাত দিবে, গ্রহীতা নয়।
৪। কোম্পানীর শেয়ার ও ব্যাংকে রাখা আমানতের (ডিপোজিট) যাকাত দিতে হবে, যদি তা নিসাব পরিমান হয়।
৫। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা উঠানোর পর যাকাত দিতে হবে। পিছনের বছরগুলোর যাকাত দিতে হবে না।
৬। যাকাত গ্রহণকারীকে নগদ টাকার পরিবর্তে অন্য কোন বস্তু প্রদান করলেও যাকাত আদায় হবে।
৭। ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজি, ভগ্নিপতি, ভাগিনা-ভাগ্নি, চাচা-চাচী, খালা-খালু, ফুফা-ফুফু, মামা-মামী, শশুর-শাশুড়ী, জামাই, সৎ পিতা, সৎ মাতা প্রমুখ লোক যদি গরীব হয়, তাদের যাকাত দেয়া যাবে এবং উত্তম। তবে যাকাত দেয়ার সময় এটা যাকাতের টাকা বা মাল। একথার বলার প্রয়োজন নেই।
৮। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গরীব ও ইয়াতীম ছাত্রদের পড়া-লেখা ও খাওয়া-পড়ার জন্য যাকাতের টাকা দেয়া উত্তম।
৯। বাসা-বাড়ীতে কাজ কর্মের যেসব চাকর-চাকরানী, দাই প্রভৃতি থাকে, তাদের কাজের পারিশ্রমিক ও বেতন হিসেবে যাকাতের টাকা ও সম্পদ দেয়া যাবে না। তবে তাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে।
১০। যাকাতের জন্য কোন মাস নির্দিষ্ট নাই। যে মাসে নিসাব পূর্ণ হবে পরবর্তী বছর সে মাসেই যাকাত দেয়া ফরজ হবে।
উপসংহার
নিশ্চয় যাকাত সম্পদকে পবিত্র ও বরকতময় (বৃদ্ধি) করে। যাকাত আত্মার পবিত্রতা সাধন করে এবং কৃপণতা থেকে মুক্ত করে উদারতা ও বদান্যতায় পরিপূর্ণ করে। আর যাকাত দারিদ্রতা দূরীভূত করে এবং তা ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি করার একটি মাধ্যম। তাই প্রতি বছর ইসলামের নির্ধারিত নীতি অনুযায়ী যাকাতের হকদারদের (প্রাপ্যদের) মধ্যে সঠিকভাবে যাকাত বন্টন করা আমাদের কর্তব্য।